গত কয়েক বছরে আমি বিভিন্ন অনলাইন বিজনেসের সাথে কাজ করেছি। আমার এজেন্সির মাধ্যমে কাজ করা ক্লায়েন্টের সংখ্যা অন্তত ২০০+ । সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করছি আমার অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করা দরকার। আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, কিভাবে একটা বিজনেস ডিজিটালি প্রফিট করে বা কেনই একটা বিজনেস অনলাইনে এসেও লস করে। আমার আজকেই এই লিখাটি সেই অভিজ্ঞতা থেকেই।
ডিমান্ড আছে এমন প্রোডাক্ট সিলেকশন
বিজনেসে নামার আগে সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত হলো সবসময়ই ডিমান্ড আছে এমন প্রোডাক্ট সিলেক্ট করা। আমাদের প্রোডাক্ট সিলেক্ট করতে দিলে বেশিরভাগ মানুষই হয়তো অরগানিক ফুড, জামা কাপড়, ঘড় সাজানোর আইটেম, বাচ্চাদের আইটেম ইত্যাদি সিলেক্ট করবো। কিন্তু আমরা একবারও ভেবেছি এই প্রোডাক্টগুলোর কম্পিটিশন কেমন?
আপনি হয়তো পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন, অমুকভাই তো এই ধরণের বিজনেস করে অনেক টাকা প্রফিট করছে। হ্যাঁ, হয়তো করছে। কিন্তু এই ধরনের বিজনেসে এখন ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। কিন্তু অমুক ভাই ছাড়া মার্কেটের বাকিদের অবস্থা আপনি জানেন?
কমন প্রোডাক্টগুলো নিয়ে বিজনেস করলে কি হয়?
- কম্পিটিশন বেশি থাকে ফলে, প্রফিট মার্জিন কম হয়।
- অনেক ক্রেতা থাকায় কাস্টমার একজনের থেকে না নিয়ে প্রচুর বাছাবাছির অপশন পায়।
- একই ধরণের প্রোডাক্টের পোস্ট মানুষ দেখতে দেখতে বিরক্ত, ফলে ভালো পোস্ট দিলেও এনগেজমেন্ট কম হয়।
- কাস্টমার নিয়মিত ইউজ করায় প্রোডাক্ট সম্পর্কে নলেজ রাখে, ফলে অন্য শপের সাথে কোয়ালিটি বা প্রাইস দ্রুত কম্পেয়ার করতে পারে।
আপনার প্রোডাক্ট সিলেকশন ভালো না হলে বাঘা বাঘা ডিজিটাল মার্কেটার ধরেও কাজ হবে না! আর হ্যাঁ, ডিজিটাল মার্কেটারের কাছে কোন জাদুর কাঠি নেই।
ডিজাইন ও কন্টেন্টে মনযোগী হওয়া
ডিজাইন ও কন্টেন্ট আকর্ষণীয় না হলে মানুষ দ্রুত স্ক্রল করে চলে যায়। আপনার প্রোডাক্টের প্রতি ভ্রুক্ষেপও করবে না। আপনি হয়তো বলতে পারেন, “আমার প্রোডাক্ট বেস্ট” কিন্তু আপনার প্রোডাক্ট ব্যবহার করার আগে কাস্টমার কি করে বুঝবে আসলেই বেস্ট কিনা? সুতরাং, প্রথমবার কাস্টমারের মনযোগ ধরে রাখতে হলে কন্টেন্ট মার্কেটিং এর বিকল্প নেই।
একটা মানুষ সোশ্যাল মিডিয়াতে স্ক্রল করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। কি ভালো লাগে সে জানে না। কোথায় থামবে সে জানে না। ভাই, তারে থামান। তাকে ৩০ সেকেন্ড/১ মিনিটের জন্যেও যদি থামাতে পারেন এটাই অনেক কিছু। আপনার কন্টেন্ট যদি আকর্ষণীয় না হয় অডিয়েন্স সোজা স্ক্রলের উপর থাকবে।
ভালো কন্টেন্ট তৈরি করতে হলে খরচ কিছু হবেই। এটা বড় বিষয় না, ব্যবসা করলে ইনভেস্টমেন্ট লাগেই। তাছাড়াও কন্টেন্ট ভালো না হলে এডের খরচ বাড়বে। ফেসবুক এডের রিচ কমিয়ে দিবে। তখন ডিজিটাল মার্কেটারের মুরিদ হলেও তখন কাজ হবে না।
ভালো কন্টেন্ট মানে কি বুঝাচ্ছেন ভাই?
- প্রানবন্ত সোস্যাল মিডিয়ায় উপস্থিতি
- মিনিংফুল ছবি/ভিডিও
- ক্লিয়ার প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি
- স্পষ্ট প্রোডাক্ট ডিটেইলস
- প্রোডাক্টের বর্ণনাতে ফিচার ও বেনেফিট তুলে ধরা
- সহজে অর্ডার করার প্রসেস বলে দেয়া
বেসিক ডিজিটাল মার্কেটিং জানা
আপনি অনলাইন বিজনেস করতে আসলে অবশ্যই আপনাকে বেসিক ডিজিটাল মার্কেটিং অন্তত জানতে হবে। আপনি যদি ডিজিটাল মার্কেটিং এর “ড” ও না জানেন তাহলে অনেকেই আপনাকে “হাইকোর্ট” দেখাবে। আপনাকে নিজেকেই জানতে হবে কোন প্রোডাক্টের টার্গেট কাস্টমার কে হতে পারে। কিভাবেই বা এই টার্গেট কাস্টমার খুঁজে পাওয়া যাবে।
বেসিক নলেজ না থাকলে আরও অনেক সমস্যা। আপনি ফেসবুকের এডস পলিসি না জানলে আপনার এড একাউন্ট ডিজেবল হওয়া সহ আপনার আইডি ফেসবুকে এড দেয়ার জন্য চিরতরে অকার্যকর হয়ে যেতে পারে। আপনাকে ভালো ভাবে জানতে হবে কোন প্রোডাক্টের এড দেয়া যাবে আর কোনটার দেয়া যাবে না।
বেসিক নলেজ বলতে কি কি বুঝাচ্ছেন বা কতটুকু জানতে হবে?
- নিখুতভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ইউজ করা জানতে হবে।
- ভালো কন্টেন্ট আইডিয়া দিতে শিখতে হবে।
- মিডিয়া বায়িং (বিভিন্ন ধরণের এড রান করা) কিছুটা হলেও শিখতে হবে। অন্তত ফেসবুক এড রান করা (বুস্ট করা) শিখতে হবে।
- ইউটিউব ভিডিও এসইও করা জানা দরকার।
- ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইট তৈরি করা ও সেখানে প্রোডাক্ট/ব্লগ পাবলিশ করতে জানা।
- এসইও (সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন) না জানলেও এর ব্যবহার ও বেনিফিট জানা।
ব্র্যান্ডিং সম্পর্কে কিছুটা জানা
ব্র্যান্ডের সংজ্ঞা দিতে গেলে অনেক কিছুই বলা যায়। সহজে বললে ব্র্যান্ড মানে এক কথায় মানুষের মনে আপনার প্রোডাক্ট/ সার্ভিস/ প্রতিষ্ঠানের নাম গেঁথে দেওয়া। আমরা একটু আশেপাশে তাকালেই বুঝবো, আমরা প্রায়ই মোটরসাইকেলকে “হোন্ডা” বলে থাকি। যেমন কেউ বাজাজ বা টিভিএসের মোটরসাইকেল চালালেও আমরা বলি “হোন্ডা নিয়ে কই জাস” আসলে এটাই ব্র্যান্ড। অনেক ক্ষেত্রে আমরা ফিক্সড প্রাইসকে বলি “বাটার দাম” ইঞ্জিন ওয়েলকে বলি “মবিল” এটাই ব্র্যান্ড।
আপনি যত ভালোই জুতার দোকান দেন না কেন, বাটার পাশে আপনার দোকান থাকলে মানুষ বাটাতেই বেশি যাবে। কারণ তারা ব্র্যান্ড। মানুষ অনেক ক্ষেত্রে পণ্য কিনে না, কিনে ব্র্যান্ড। আপনার পণ্য ব্র্যান্ডের চেয়ে কোন অংশে কম না হলেও দেখা যাবে কাস্টমারের ব্র্যান্ডের প্রতিই বেশি ঝোঁক।
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, ভাই ১/২ লাখ টাকা নিয়ে অনলাইন ব্যবসায় নামছি কিন্তু আপানি বলেন ব্র্যান্ড বানাতে? এটা কি এতই সস্তা?
না ভাই, ব্র্যান্ড মোটেই সস্তা না। উপরের কথায় আমি আপনাকে গ্লোবাল বা ন্যাশনাল ব্র্যান্ড বানাতে বলিও নি। আপনার টার্গেট কাস্টমার যারা, তাদের সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় সম্পর্ক গড়ে তুলুন। হোক সেটা ছোট বা খুবই ক্ষুদ্র অডিয়েন্স। তাদের মনে বিশ্বাস গড়ে তুলুন আপনার প্রোডাক্টের মান আসলেই ভালো। তারা যত টাকা দিয়ে প্রোডাক্ট কিনছে তা আসলে “Value for Money” মানে কাস্টমার আপনার পণ্য কিনে নিজেকে “জিতছি-জিতছি” ভাবে রাখবে। এক্ষেত্রে একটা ফেসবুক গ্রুপ খুব ভালো কাজ করবে।
আমি ফেসবুকে এমন কিছু পেইজ দেখেছি যারা তাদের ড্রেসগুলো নিয়ে লাইভে আসা মাত্রই লাইভ চলাকালীন প্রোডাক্ট স্টকআউট হয়ে যায়। মানে অল্প কিছু সময়ে সব প্রোডাক্ট বিক্রি হয়ে যায়। এটা আসলে তাদের ব্র্যান্ডিং। সেটা তাদের ক্ষুদ্র অডিয়েন্স নিয়েই হোক।
বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়ায় সরব উপস্থিতি
আজকে একটা ফেসবুক পেজ খুলে কালকেই সেল করে ফাঠিয়ে ফেলবেন বিষয়টা কিন্তু এতো সহজ না। শুধু ফেসবুক পেজ খুললেই হবে না, অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া যেখানে আপনার সম্ভবনাময় অডিয়েন্স আছে সেখানেও পেজ খোলা উচিত। একটা সোশ্যাল মিডিয়া পেজ খুলে আপনাকে অন্তত কিছু পোস্ট করতে হবে।
সব সেল পোস্ট হলে হবে না। পাশাপাশি এংগেজিং পোস্ট (অডিয়েন্সকে পেজে ধরে রাখা) নিয়মিত করতে হবে। অডিয়েন্স স্বেচ্ছায় লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার করে এমন পোস্ট করতে হবে। এটা যদিও কখনো কখনো ফানি পোস্ট হয়, ক্ষতি নেই।
আপনার পেইজে পর্যাপ্ত কিছু লাইক/ফলোয়ার থাকা দরকার। অনেক অডিয়েন্সই পেজে পর্যাপ্ত লাইক/ফলোয়ার না দেখতে কিনতে আস্থা পায় না। তাই প্রথমদিকে পেইজে অবশ্যই লাইক বাড়ানোতে মনযোগী হওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে কিছু পেইড লাইক (ফেসবুকে এড রান করে) হলেও ক্ষতি নেই।
অন্যের কন্টেন্ট কপি করা যাবে না
একবার এক ভদ্রলোক আমার একটা কোর্স কিনেছে একটা “ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম” থেকে। তারপর একদিন সাপোর্ট গ্রুপে পোস্ট করলেন যে তার পেজ বার বার রেস্ট্রিকটেড হয়ে যাচ্ছে। মানে ফেসবুক রেস্ট্রিকটেড করে দিচ্ছে। পেজটা চেক করে দেখলাম সব ছবি আলিবাবা থেকে কপি করা। আমি রিপ্লাইতে বললাম অন্যের কন্টেন্ট কপি করলে পেইজ রেস্ট্রিকটেড হবেই। পাল্টা রিপ্লাইতে তিনি বললেন, অনেকেই তো কপি করে শুধু আমার পেইজ কেন রেস্ট্রিকটেড হলো। আমি বললাম, ফেসবুক মানুষ না একটা রোবট, ফেসবুক যখন যে পেইজকে ধরে। কেউ দুইদিন আগে ধরা খায়, কেউ দুইদিন পর ধরা খায়। কপিরাইট লঙ্ঘন করলে ধরা খাবেনই। এতপর ভদ্রলোক অফিসে কম্পেইন করলেন মেন্টর সলিউশন দিতে পারে নাই তিনি তার কোর্সের মূল্য ৫০০ টাকা ফেরত চান!
তার মানে আমরা অনেকেই হয়তো অন্যের কন্টেন্ট (ছবি/ ভিডিও/ টেক্সট) কপি করাকে নিজের অধিকার মনে করি। দেদারছে অন্য পেইজের পোস্ট/ ছবি কপি করে নিজের পেইজে কপি করে দেই। আর সেলের আশায় বসে থাকি। আসলে এত আনাড়ি একটা কাজ আপনারা কিভাবে করেন?
বিভিন্ন সময়ে ফেসবুক চিরুনি অভিযান চালায় ও গণহারে পেইজ/ এড একাউন্ট/ আইডি রেস্ট্রিকটেড করে দেয়। আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি এর একটি বড় কারণ অন্যের কন্টেন্ট কপি করা বা ফেসবুকের পেমেন্ট ফাকি দেওয়া।
সবশেষে বলবো রাতারাতি কিছু একটা করে ফেলা মানে অনলাইন ব্যবসা না। অনলাইন ব্যবসা করতে হলেও আপনাকে জানতে হবে প্রোডাক্ট, মার্কেটিং বা কন্টেণ্ট তৈরি করা সম্পর্কে। কিছু না জেনেই হুট করে নেমে পড়ার পরিনাম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই “লস প্রজেক্ট”।
Very uesfull content love you boss
লেখা ঠিক আছে।
মানুষ যে কি ভাবে অনলাইন বিজনেসকে!
কোনো কম্পিটিটর রিসার্চ নাই, পজিশনিং নাই, ব্যবসা করবে।