ধেয়ে আসছে চতুর্থ শিল্প বিল্পব। হয়তো এর ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করছে এখনই। আসলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কি?
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হলো এক কথায় অটোমেশনের বিল্পব। যেখানে ধরা হয় মানুষের পরিবর্তে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যাক্তিগত বেশিরভাগ কাজ অটোমেশনের মাধ্যমে সম্পাদিত হবে।
ধরুন বিকাশের কথাই বলি, ডেইলি প্রায় কয়েক লক্ষ লেনদেন হচ্ছে বিকাশে। এই লক্ষ লক্ষ লেনদেন যেখানে পেমেন্ট, সেন্ডমানি, বিল পে, ডোনেশন ইত্যাদি বিকাশ ইউজাররা করছে। নির্দিস্ট কিছু শপে কাস্টমার ক্যাশব্যাক পাচ্ছে তাছাড়াও পাচ্ছে বিভিন্ন অফার, ইন্টারেস্ট, পয়েন্টস ইত্যাদি। এই সমস্ত কিছুই হচ্ছে অটোমেশনের মাধ্যমে।
যদি বাস্তবিক অর্থে অটোমেশন না হয়ে ম্যানুয়ালি এই সকল লেনদেন সম্পাদিত হতো তাহলে প্রয়োজন পড়তো হাজার হাজার হিসাবরক্ষকের! অর্থাৎ এখানে অটোমেশনের ফলে এই হাজার হাজার হিসাবরক্ষকের কাজ একটি সিস্টেমে পরিচালিত হচ্ছে। এটাকে আমরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একটা ছোটখাটো উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি।
বিস্তারিত বলতে মানুষের পরিবর্তে অটোমেশনের দ্বারা প্রোডাকশন, মার্কেটিং, সেলস, হিসাব, সাপোর্ট সবই পরিচালিত হবে। এই পরিবর্তনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
তাহলে কথা হচ্ছে কি ঘটতে পারে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে? উদ্বেগটা আসলে কোথায়?
পরিবহণ খাতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
একজন সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালক, তিনি এখন স্বাধীনভাবে সিএনজি চালিয়ে আয় করছেন। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি তিনি কিন্তু এখন আর পুরোপুরি স্বাধীন না! তিনি উবারের মাধ্যমে ট্রিপ দিলে তার আয়ের ২০-৩০ % উবারকে দিয়ে দিতে হবে। যদি কাস্টমাররা সবাই রাইড শেয়ারিং এপে সিএজনি কল করে তাহলে সব টেক্সি চালক, সিএনজি চালক, ট্রাক চালক সবাই কিন্তু পরাধীন। এখানে সবাই স্বাধীনভাবে আয় করছে বললে ভুল হবে অনেকটা তারা রাইড শেয়ারিং কোম্পানির আন্ডারে জব করছে বললে ভুল হবে না।
কৃষিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
কৃষিতে বড় বড় মেশিনের সাহায্যে বিস্তীর্ণ জমির ফসল খুব অল্প সময়েই কেটে ফেলা হচ্ছে। আর সেই ফসল প্রক্রিয়াকরণ করতে আরও বেশি মেশিনের সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। এখন ভেবে দেখেছেন কি একটা প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের কতটুকু সামর্থ্য আছে সেই মেশিন কেনার? আসলেই নেই, তাহলে এখন সেই কৃষককে মেশিনগুলো অনেক টাকায় ভাড়া নিতে হবে বা একজন মিল মালিকের কাছে ক্ষেত থেকেই ফসল বিক্রি করে দিতে হবে।
অপরভাবে যদি চিন্তা করি যে দিনমজুর কৃষি ক্ষেতে মজুরি দিতো তারও বা কি হবে? তার জব কি স্বয়ংক্রিয় মেশিন নস্ট করে দিচ্ছে না?
একজন কৃষক কিন্তু এখন অনেকাংশেই বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির জন্য বড় বড় কোম্পানির নিকটস্থ হয়। একটু লক্ষ্য করেই দেখবেন অনেক বড় বড় কোম্পানিই কিন্তু এখন তাদের এগ্রিকালচার ভেঞ্চার খুলছে। অদূর ভবিষ্যতে যদি এমন হয় যে, কোম্পানিগুলো জমিতে চাষাবাদ করবে আর কৃষকরা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যদিও আগেই বলেছি কৃষিতেও শারীরিক শ্রমের ব্যবহার অনেক কমে যাবে। মানে খুব বেশি পরিমাণ শ্রমিকের প্রয়োজন হবে না।
ক্যাশলেস ট্রান্সেকশন ও ডিজিটাল ব্যাংকিং
সাধারণত আমরা আমাদের উদ্বৃত্ত ক্যাশ টাকাকে ব্যাংকের কাছে জমা রেখে আসি। সেখান থেকেই ব্যাংক আমানত পায় ও সেই আমানত বিনিয়োগ বা ঋণ দানে কাজে লাগায়। কিন্তু এখন আমাদের কিন্তু ব্যাংকের কাছে আমানত জমা রাখতে হচ্ছে না, অটোমেটিক্যালি আমাদের সব টাকা ব্যাংকের কাছে! যেমন একটা কোম্পানি যা সেল করছে অটোমেটিক্যালি পেমেন্ট গেটওয়ের মাধ্যমে তার ব্যাংকে জমা হয়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে সকল ইমপ্লোয়ীর সেলারি বা যাবতীয় খরচ ব্যাংকের মাধ্যমেই প্রদান করছে। ইমপ্লোয়ীরা তাদের সেলারি ব্যাংক থেকে উত্তোলন না করেই কার্ড/মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে প্রদান করছে। অর্থাৎ যা ট্রান্সএকশন হচ্ছে সবই ব্যাংকের মাধ্যমে বা MFS (মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে)।
এই ক্যাশলেস লেনদেনের ফলে মুলত কি হবে? ছোট ছোট ব্যাংকগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হিমসিম খাবে বা অনেক ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ ছোট ব্যাংকগুলোর কিন্তু MFS সার্ভিস নেই। কিংবা ৩৬০ পেমেন্ট সলিউশন দিতে পারছে না। আপনারা একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন বাংলাদেশে নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলো আসলেই লাইফ সাপোর্টে আছে।
একটু কি চিন্তা করছেন যিনি ব্যাংকের ক্যাশিয়ার বা বিশাল বিশাল টাকার বান্ডেল গুনতেন তার কি হবে? যেখানে ক্যাশ টাকাই থাকবে না সেখানে ক্যাশিয়ার দিয়ে কি হবে। যখন ব্যাংকের টোটাল ট্রান্সএকশন অটোমেশনের মাধ্যমে হবে তখন এই টাকার হিসার রাখার জন্য মোটেও এত একাউন্টেন্টের প্রয়োজন হবে না। শুধু ডিসিশন মেকিং এর জন্য বড় পোস্টে কিছু একাউন্টসের জব থাকবে।
কারেন্সির ক্ষেত্রে ক্রিপ্টোকারেন্সি কিন্তু এখনই অনেক ক্ষেত্রে ডমিনেট করছে। বিভিন্ন ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিও ক্রিপ্টো কারেন্সিতে পেমেন্ট নিচ্ছে। অনেক দেশে ক্রিপ্টোকারেন্সির উপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। অদূর ভবিষ্যতে ক্রিপ্টো ডমিনেট করলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
শিক্ষাক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
গ্রামের শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে পড়াশোনার জন্য ভালো সুযোগ পায় না। গ্রামের শিক্ষার পরিবেশ, প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা, আর্থিক সঙ্গতি ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই গ্রামের ছেলে/মেয়েরা পিছিয়ে। এখন কথা হচ্ছে অনলাইন শিক্ষা কি এই দূরত্ব অনেকাংশেই কমাতে সক্ষম নয়?
অনলাইন ক্লাসের ফলে যেকোন যায়গা থেকে যেকোন শিক্ষার্থী ঘড়ে বসেই শিখতে পারে। চাইলে ইউটিউব থেকে বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রফেসরের লেকচারও শুনতে পারে। মোটকথা চতুর্থ শিল্প বিল্পব এখানেও “সবার জন্য শিক্ষা”র একটি বড় নেয়ামত হতে পারে।
এবার আসি মূল পয়েন্টে, একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা না করেও নামমাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট নিয়ে নিজেকে গ্রাজুয়েট দাবি করতেই পারেন। কিন্তু আসলেই কি তিনি গ্লোবাল মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন? অবশ্যই না।
তাহলে শিক্ষার ক্ষেত্রেও এমন কিছু পরিবর্তন আসবে যেখানে সবাই IELTS, GRE, GMAT, TOEFL ইত্যাদি গ্লোবালি স্বীকৃত স্কোর নিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে যদি এমন হয় কারো বিশ্ববিদ্যালয়য়ের কোন ডিগ্রি নেই, কিন্তু তিনি ইন্টারনেট থেকে ক্লাস করে ভালো স্কোর করেছেন অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এমন যদি হয় IELTS, GRE, GMAT, TOEFL ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতেও কোন শিক্ষাগত যোগ্যতার দরকার পড়বে না হয়তো একসময় সেটাও সম্ভব হবে।
ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম যেমন Udemy, Coursera এর মত প্রতিষ্ঠানগুলো হবে তখন লার্নিয়ের সবচেয়ে বড় সোর্স। এখন তাহলে সমস্যাটা কোথায়? যদি আসলেই শিক্ষায় তাই ঘটে, তবে ১০ অনুপাত ১ যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত আছে তা টিকবে না। একজন শিক্ষক একটা প্রি রেকর্ডেড কোর্সে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে পাঠদান করতে পারবেন। সমস্যা সমাধানের জন্যও শিক্ষার্থীরা অনলাইন কমিউনিটিতে সমাধান পাবেন। মানে শিক্ষকের সংখ্যা অনেকাংশেই কমে যাবে।
ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষেত্রে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিন্তু চাইলেই একটা মুদির দোকান বা খাবারের হোটেল খুলে বসতেই পারেন। কিন্তু আমরা কি লক্ষ্য করেছি সুপারশপগুলো কিভাবে মধ্যবিত্ত মানুষদেরও তাদের কাস্টমার বানাতে পেয়েছে। একটা সুপার শপ বাল্ক (প্রচুর পরিমাণে) বিক্রি করে ফলে তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রোডাক্টে অফার দিতে পারে যেটা ক্ষুদ্র মুদির দোকানদার দিতে পারবেন না। বিকাশ/নগদ/ব্যাংকের সাথে যে পার্টনারশিপ সুপারশপগুলো করছে তা মুদি দোকানদার করতে পারবেন না। আমি কার্ডে/এপে পে করলে যদি ক্যাশব্যাক পাই তবে আমার সুপারশপে যেতে বাধা কোথায়?
তারপর আসি ই-কমার্স, আমরা জানি বাংলাদেশের মোট ক্রয়ের ১৫% হচ্ছে অনলাইন। যা দিন দিন আরো বাড়বে। মানে যে ১৫% ক্রয় মানুষ আগে দোকান থেকে কিনতো তা এখন অনলাইনে কিনছে। ফলে অফলাইনে ব্যবসা শুরু করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে হাজার হাজার কালেকশন নিয়ে আসছে কিংবা বিভিন্ন অফার প্রমোট করছে তা কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পারবেন না। ফলে বাধ্য হয়ে ৮% – ২০% পর্যন্ত কমিশন দিয়ে ব্যবসায়ীরা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সেলার হচ্ছেন। মানে, সেই আগের কথা এখানেও ব্যবসায়ীরা অনেকাংশে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে পরাধীন।
ভাবছেন হয়তো অনলাইনে ফুড বিক্রি করবেন কিন্তু সেখানেও আছে ফুডপান্ডা, পাঠাওয়ের আধিপত্য। আপনার নিজের সেল বাড়াতেই কিন্তু আপনি ২০%-৩০% কমিশন দিয়ে ফুড ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মে রেজিস্ট্রেশন করছেন, এখানেও আপনি পরাধীন।
প্রশ্ন আসতে পারে, এখানে পরাধীন বলতে আমি কি বুঝাচ্ছি? কেনইবা বার বার এই শব্দটা ব্যবহার করছি? কারণ, এখন যদি ই-কমার্স, ফুড ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম তাদের কমিশন বাড়িয়ে দেয় কিংবা সেলারদের সার্থবিরোধী কোন সিদ্বান্ত নেয় তবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ির হাতে কিন্তু খুব বেশি অপশন নেই।
ট্র্যাডিশনাল জবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
একজন ট্র্যাডিশনাল সেলসম্যান ডেইলি কয়টা সেল করতে পারবেন? ডেইলি কয়টা ক্লায়েন্ট মিটিং করতে পারবেন? কিন্তু একজন ডিজিটাল মার্কেটার একটা ডিভাইস ও কিছু টুল ইউজ করে মিলিয়ন অডিয়েন্সের কাছে রিচ করতে পারেন। ফলে ট্র্যাডিশনাল জবগুলো আসলেই কমে আসবে। আমি বলছি না ট্র্যাডিশনাল মার্কেটিং কিবা সেলস একেবারেই থাকবে না। কিন্তু এক্ষেত্রেও ডিজিটাল সেলস/মার্কেটিং ডমিনেট করবে।
তেমনিভাবে সকল কায়িকশ্রমের কাজ আধুনিক মেশিনগুলো দ্বারা করা হবে। যে কাজটি ১০০ জন শ্রমিক করতো সে কাজটি একটি মেশিন করবে, সেখানে চাকরি থাকবে শুধু মেশিন অপারেটরের।
অনেকেই বলতে পারেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আসলে জব কেড়ে নিবে না। আমিও আংশিকভাবে একমত জব কেড়ে নিবে না, কিন্তু কমিয়ে দিবে ও জব রোল চেঞ্জ করে দিবে। যেমন এখন প্রচুর মানুষ, কোডিং, ডিজাইনিং, ডিজিটাল মার্কেটিং শিখছে ফলে তাদের জব রোল চেঞ্জ হচ্ছে কিন্তু তারা জবলেস হচ্ছে না। জবলেস তারাই হবে যারা অটোমেশনের সাথে নিজেকে এডপ্ট করতে পারবে না।
আমার এই লিখার উদ্দেশ্য হলো, সামগ্রিকভাবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কি প্রভাব পড়তে পারে সেই সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়া। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মিডলম্যান কমিয়ে দিবে। একজন চাকরিজীবীর মত সবাই কোম্পানিগুলোর কাছে পরাধীন থাকবে।
এই লিখাটি শুধুমাত্র আমার ব্যক্তিগত মতামতের উপর ভিত্তি করে লিখা। এই লিখার অনেক কথাই আমার স্ব-চিন্তা ও ধারণাপ্রসূত। আমার লিখার সাথে একমত হতে হবে এমন কোন কথা নেই।
0 Comments